বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০

পান -কাহিনি


পান-কাহিনি
-------------------

মূল: আতীক উল্লাহ

সংযোজন-সংশোধন: আশরাফ আলী সুমন

এক.
পান খাওয়া একটা আর্ট। উপমহাদেশের গরিবের বিলাসী আয়েশ। বনেদি বড়লোকদের কারও কারও মধ্যেও পানবিলাস আছে। আমাদের জাতীয় কবিকে একবাটা পান দিয়ে বসিয়ে দিলে আর দেখতে হতো না! পানের রসের সাথে সাথে থাকত গানের পর গান। 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস' এভাবে তার কাছ থেকে বহু গান বাগিয়ে নিয়েছে।

★★★

পান খাওয়া কাকে বেশি মানায়? নারী না পুরুষকে? আমরা একবার বিষয়টা নিয়ে ঘরোয়া বিতর্কের আয়োজন করেছিলাম। বেশ মজার এক বির্তক হয়েছিল। অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর সব যুক্তি উঠে এসেছিল পক্ষে-বিপক্ষে। শেষ দিকে অবশ্য পানের চেয়ে লাল ঠোঁট নিয়েই বির্তক বেশি জমে উঠেছিল।

দুই.
এশার পর পুরো কামরা সুনসান। সবই পড়ছে। কেউ কেউ গুনগুন করে বন্ধুর সাথে কথা বলছে। সবাই নিচু গ্রামেই আওয়াজ করছে। পরদিন সুল্লামুল উলূম কিতাবের কঠিন পড়ায় মগ্ন। জাঁদরেল ডাকসাইটে বাঘ 'আইয়ুব সাহেব হুযুর' এর পড়া শিখছি। সামনের পড়াটাও ঠিক করে রাখছি। পড়া না পারলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন। তটস্থ অবস্হা। রাতের মধ্যেই পড়াটা 'পেড়ে' ফেলতে হবে। পাশাপাশি কানটাও খোলা। কিছু একটার জন্য তৃষ্ণার্ত-চাতক-প্রতীক্ষা। উৎকর্ণ। দশটার কিছু আগেই সাধারণত ঘটনাটা ঘটে।

★★★

সময়ের খুব বেশি হেরফের ঘটে না। আজও ঘটল না। ঘড়ির কাঁটা তখন ন'টা পঁয়তাল্লিশের ঘর পেরিয়েছে। দরজা খুলে গেল, সাথে সাথে গুঞ্জরিত হলো,

পান খায়ে সাঁইয়া হামারো
সম্ভালি সূরতিয়া হোঁট লাল লাল
হায় হায় মলমল কা কুর্তা
মলমল কে কুর্তে পে ছিট লাল লাল!

আমাদের কামরার মুহাম্মদ রফি ছিল খুরশিদ (ছদ্মনাম অবশ্যই)। মায়ানমারের রসিক পানসেবী। জীবনে বহু পানখোর দেখেছি, লেকিন ওইসা কভি নেহি!। মানুষ তো পান খায়। আমাদের মনে হতো খুরশিদ পান নয়, যেন মান্না-সালওয়া খাচ্ছে। সবাই পিচিক করে পানের পিক ফেলে দেয়, সে ফেলতো না। কার সোজাসাপ্টা বক্তব্য:
-পিক ফেলব তো পান খাওয়া কেন? পিক না গিললে কি নেশা জমে? পানের পিক হলো  শরাবান তাহুরা। বলবাড়িষ্ঠাসিক সালসা!

সে পান তো খেতই, সাথে সাথে পানবিষয়ক অসংখ্য গান-কবিতা, শের-আশআরও মুখস্হ করেছিল। আড্ডায় বসলে সে তার 'পানবাহার' খুলে বসত। তার বেশি প্রিয় ছিল 'পান খায়ী'টা। প্রতিদিনই দিনের শেষে খিলি মুখে দিয়ে পানের জারক রসে আপ্লুত হয়ে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে রুমে ফিরত। প্রতিটি লাইনকে সে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে গাইত। ছুটির দিনে মন ভালো থাকলে সে নাচসহই পরিবেশন করত। ঠিক যেন 'জীবন্ত পুরুষ ওয়াহিদা রেহমান'। তার কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ভেঙে পড়তাম। খুরশিদ নির্বিকার। নেচে গেয়ে 'পান-উপাসনা'করছে!
তৃতীয় লাইনটাকে একটু এদিক-সেদিক তরে গাইত,
হায় হায় টেট্রন কা কুর্তা
টেট্রন কে কুর্তে পে ছিট লাল লাল
খুরশিদ সস্তা টেট্রন-পলিস্তারের 'কুর্তা' গায়ে দিত। বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে কুর্তার ওপর কিছুটা পিকের লাল ছিটাও ছিটিয়ে দিত। গাওয়ার সময় পুরো মুদ্রার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিত কীভাবে পান বানাতে হয়। নাচটা শিখেছিল সে 'আরেকজন'কে দেখে দেখে!

রাত দশটায় হোস্টেলের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। আর বেরুবার উপায় ছিল না। আগে জানতাম মদের নেশা চাপে। হিরোইনের নেশা চাপে। কিন্তু পানেরও যে দুর্দম দুর্নিবার নেশা চাপে সেটা জানা ছিল না। সেই প্রথম দেখলাম।

★★★

এক গভীর রাতে খুরশিদের পানের 'টক' উঠল। এখন উপায়? চুপি চুপি পাশের জনকে ডেকে তুলল। সেও খুরশিদের পান-স্যাঙাত। তার কাছে তালিম নিচ্ছে পান-উপাসনার। তার এখন 'জর্দাচেনা' পর্ব চলছে। কোন জর্দার কী নাম। কেমন স্বাদ।
তাদের দুজনের অনুচ্চ ফিসফিসও নিঝুম রাতে সুউচ্চ হয়ে কানের সোনার সিস্টেম ধরা পড়ল। চোখ খুলতেই দেখলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুজন কথা বলছে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। আলগোছে ছিটকিনি খুলে বাইরে গেল। গোয়েন্দা মন টিকটিক করে উঠল। চোখ ঠেরে বলল:
-ওনে! তাড়াতড়ি পিছু নে, না হলে কিছু একটা মিস করে ফেলবি।
তড়াক করে উঠেই চুপিচপি পিছু নিলাম। ওরা দুজন চলতে চলতে মাদরাসারপূর্ব কোণের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। দূর থেকে তাদের ভাবগতি বুঝতে পারছিলাম না। একটা নারকেল গাছ আছে দেয়ালের কাছটিতে। খুরশিদ প্রথমে ওটার চড়তে শুরু করল। আচ্ছা! নারকেল চুরি হচ্ছে! না, এবার স্যাঙাতও চড়তে শুরু করল। গাছ থেকে টপকে দেয়ালের ওপাশে নামল। মাদরাসার বাইরে। কিছুক্ষণ বোবার মতো দাঁড়িয়েথেকে ফিরে এলাম। দেয়াল টপকানোর সাহস হলো না। ফজরে উঠে দেখলাম দুই পানসাধক তখনো লাপাত্তা। ব্যাপার কী? রাতে ফিরতে পারেনি? নাকি দেয়াল টপকাতে গিয়ে বেঘোরে হাত-পা ভেঙেছ!

নামায পড়ে বের হলাম। শাহী গেইটের কাছে বড়সড় জটলা। কাছে গেলাম। শুনলাম রাতে দুজন চোর  ধরা পড়েছে। মাদরাসার কয়েদখানায় আটকে রাখা হয়েছে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, ওরা নয় তো! কাছে গিয়ে দেখি, অনুমান সত্যি! খুরশিদ কয়েদখানায় বসে তখনো নির্বিকারচিত্তে পান চিবুচ্ছে। আর পান-স্যাঙাত বেজার মুখে বসে আছে।

আমরা কামরার সবাই গিয়ে অনেক বলে-কয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম। কামরায় এসেই চেপে ধরলাম,
-পানগুরু! ঝেড়ে কাশো দেখি চাঁদু!
-আর বলিন না! রাথে ভীষণ পানের টক উঠল। প্রতিরাতে বাড়তি কয়েক খিলিব প্যাকেট করে নিয়ে আসি। কাল আনা হয়নি। বাইরে গেলাম পান খেতে। দুঃসাহসীক অভিযান। রেলস্টেশনে গেলাম। দোকান বন্ধ। ডাকবাংলা গেলাম, সব বন্ধ। থানার দুয়ারে গেলাম। মদীনা হোটেলের সামনের দোকানটাও তখন প্রায় বন্ধ হবে হবে করছে। দৌগে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ওখানে দাঁড়িয়েই ডাবলখিলি সাঁটালাম। দশ খিলি বাড়তি পকেটে পুরে রওনা দিলাম।

সব ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। আমি গাছ বেয়ে উপরে উঠে গেছি, শিষ্য তখনো ওপারে। টেনে তুললাম। লাফ দিয়ে নামলাম। ওটাই ভুল হয়ে গেছে। দুপ করে আওয়াজ হলো। ভাগ্য খারাপ। দারোয়ান তোতা মিঞা তখন ওই এলাকায় টহল দিচ্ছিল। আওয়াজ শুনে তিন ব্যাটারি লাইট মারল। আর যায় কোথায়! আমি দৌড়ে পালাতে পারতাম। কিন্তু শিষ্যটা আলোর ঝলকানিতে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। কী আর করা, ওর জন্যে আমিও আটকা পড়লাম।
আহাঁ! হামনে মাঙায়ী সুরমেদানী
লে আয়ি জালিম বেনারস কা জর্দা!
একরাত কারাবাস করে আমাদের 'পানগাজী' আরও পান-রসিক হয়ে উঠল। প্রতি রাতেই তার সুর ঝংকৃত হতো,
=পান খায়ে সাঁইয়া হামারো....

★★★

এ তো গেল একদিনের ঘটনা। পান নিয়ে এমন হাজারো পানাহার আছে। পান-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুরশিদের কিছু গবেষণা আছে।
(ক) কোন পান বেশি মিষ্টি, গোড়ার, মধ্যের নাকি আগার? কোন এলাকার পান, মহেশখালী নাকি অন্য কোন জায়গার পান বেশি মিষ্টি?
(খ) সুপুরির প্রকার নিয়েও আছে। পানিতে মদানো-গ্যাঁজানো সুপুরির স্বাদ বেশি নাকি শুকনোটার? শুকনোটারমধ্যেও সেদ্ধ করা সুপুরি নাকি সাধারণটা?
(গ) পানের পিক ফেলা হবে কি না, ফেললে ক'বার?
(ঘ) দিনে কয় খিলি মারতে হবে? কতক্ষণ পর পর?
(ঙ) কীভাবে পান খেলে ঠোঁট বেশি লাল হবে?
(চ) পান খাইয়ে কীভাবে 'ইয়ে'-কে বশ করা যায়! এটা ছিল খুরশিদ'স এক্সক্লুসিভ ওয়ান!

পানবিষয়ক আরও কিছু 'অফ দ্য রেকর্ড' বিষয় খুরশিদের ট্যাঁকে ছিল। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে বের হতো সেগুলো। দুর্লভ মুক্তোর মতো। মাদরাসা ছুটির আগের রাতের আড্ডায়, পরীক্ষার শেষদিন বিকেলেই সাধারণত তার কাছ থেকে আমরা এসব দক্ষিণা পেতাম।

এমনিতেই মাদরাসাজীবনে আমাদের আনন্দের উপকরণের কোনো অভাব ছিল না। তার ওপর খুরশিদের মতো যদি জীবন্ত 'পান খায়ে সাঁইয়া'-ধর্মী আনন্দ-বোমা সাথে থাকে, আর কিছু লাগে!

★★★

খুরশিদের রেওয়ায়েত করা একটা পান-ঘটনা বলে শেষ করি।
-(ওয়া বিহি ক্বালা হাদ্দাসানা খুরশিদ): আমাদের এক পাড়াতো ভাইয়ের বিয়ে। দাওয়াত পেলাম। পান পরিবেশনের দায়িত্বটাও যথারীতি আমার কাঁধেই বর্তায়। সব কাজ শেষ। দুলাকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা ভীষণ উত্তেজিত। এখনকার বোকাসোকা বরগুলো তো বাসরে যাওয়ার আগে 'রেড বুল' খায়। ভাবে তারাও 'বুল' হয়ে উঠবে! যত্তসব রাবিশ! আরে, ভালো করে একখিলি পান খেয়ে যা! আর কিছুই লাগবে না। এতেই 'বুল' বাবা ফুল হয়ে উঠবে। বদ্দাকে বললাম: 
-খুইল্যা (সেজো ভাই)! একদম নিশ্চিত থাকুন। এক খিলি বিশেষ ফর্মুলায় পান বানিয়ে দিচ্ছি! দেখবেন কোন ফাঁকে রাত কেটে গেছে টেরও পাবেন না।
-ঠিক আছে দে!
আমর্ পান খাইয়ে বদ্দাকে ঠেলে ঠেসে 'সোহাগরাত'-রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম। বদ্দা লাল ঠোঁটে, চকচকে চোখে চলে গেলেন। আমরা হঠাৎ একা হয়ে গেলাম। পাঁচ মিনিটও যায়নি, ভেতর বাড়ি থেকে হইচই শোনা গেল। কী হলো! কী হলো! দৌড়ে গেলাম। দুলা নাকি বেহুশ হয়ে গেছে। প্রথমে মাথা চক্কর দিয়েছিল, বড় বড় ঢেকুর উঠতে শুরু করেছিল। একপর্যায়ে বমি করে নেতিয়ে পড়েছে। দেখলাম, বেহুশ হয়নি।অর্ধচেতন অবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল। আসলে পানটা উত্তেজনার মধ্যে হজম করতে পারেনি। নতুন বউ অল্প সময়েই স্বামীর প্রেমে কুঁইকুঁই করে কাঁদছে। বর উঠল:
-দুলাকে পান কে খাইয়েছে?
-খুরশিদ্যে!
খুইশ্যা হডে, ইতেরে দরি আন!
দেখলাম, অবস্হা বেগতিক। এক দৌড়ে পালিয়ে এলাম। একমাস আর বাড়িমুখো হইনি। পান-চিকিৎসা বন্ধ!

★★★

একটা পানীয় বাণী পড়ে বিদায় নিই:
-পান আর নারীতে কোনো পার্থক্য নেই। পান কোমল, নারীও কোমল। পান বরজের মধ্যে মাচানের আড়ালে থাকে, নারীও পর্দার মধ্যে থাকে। এর ব্যতিক্রম হলে পান সূর্যের আলোয় নষ্ট হয়ে যায়, পর্দাহীন নারীও পুরুষের কুদৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে পড়ে বা পুরুষকে নষ্ট হতে সহায়তা করে। এছাৃড়াও পান আর নারীর মধ্যে বড় একটা মিল আছে....(সেন্সরড)।
(আও কামা কালা...)। -বিশিষ্ট পান-দার্শনিক খুরশিদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কেন তিনি জাতীয় কবি। বিদ্রোহী কবি। সাম্যের কবি।

কেন তিনি বিদ্রোহী 'কবি? কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কবিতা যুগে যুগে কোটি তরুণকে দ...