আল কুরআনে আল্লাহ বলেন,
"আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় বিচার ও ইহসানের নির্দেশ দিচ্ছেন"।
নবীজী (সাঃ)র উপস্হিতিতে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে নবী ছাড়া আর কারো আসীন হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তাই মদীনা রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ও ছিলেন মুহাম্মাদ (সাঃ)।
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময়ে মাঝে মধ্যে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব পালন করেছেন আবু বকর (রাযিঃ), উমর (রাযিঃ), উসমান (রাযিঃ), আলী (রাযিঃ), আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাযিঃ), উবাই ইবনে কাব (রাযিঃ), এবং মুয়ায ইবনে জাবাল (রাযিঃ)।
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বাযান ইবনে সামানকে ইয়েমেনে, মুহাজির ইবনে উমাইয়াকে কিন্দা ও ফাদাক এলাকায়, যিয়াদ ইবনে লবীদুল আনসারীকে হাজরামাউতে, আবু মুসা আলআশোয়ারীকে যুবায়দ, যামআ ও আদন অঞ্চলে, মুয়ায ইবনে জাবালকে জুন্দে, আমর ইবনে হামযাকে নাজরানে, ইয়াজিদ ইবনে সুফিয়ানকে তাইমায়, ইত্তাব ইবনে উসাইদকে মক্কায়, আমর ইবনুল আসকে আম্মানে এবং আলা ইবনে হাদরামীকে বাহরাইনে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। আইন শৃঙ্খলা সংরক্ষণের সাথে সাথে তারাঁ বিচার ফায়সালাও করতেন।
আবু বকরের (রাযিঃ) শাসনকালে তিনি নিজেই ছিলেন প্রধান বিচারপতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত গভর্ণরগণ বিচার ফায়সালায়দর দায়িত্বও পালন করতেন। তারঁ শাসনকালে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্হা উপড়িয়ে ফেলার ডেই ভয়াবহ ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়েছিলো তার মুকাবেলায় তাঁকে অনেক সময় খরচ করতে হয়। তদুপরি তাঁর শাসনকালই ছিলো মাত্র দু'বছর তিন মাস। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্হা গড়ে তোলার সুযোগ তিনি পাননি। কিন্তু উন্নত মানের ব্যক্তিদের হাতে প্রশাসন ও বিচারের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকার সুবিচার বিন্দুমাত্রও বিঘ্নিত হয়নি।
উমর (রাযিঃ) তাঁর শাসনকালের উক্ত ব্যবস্হাই বহাল রাখেন।শিগগির তিনি উপলব্ধি করেন যে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করে ফেলাই উত্তম।
তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বিচারক নিযুক্ত করে তাঁদের জন্যে যেই ফরমান পাঠান তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপঃ
১. বিচারক সব মানুষের সাথে সমান ব্যবহার করবেন।
২.সাক্ষ্য প্রমাণের দায়িত্ব সাধারণতঃ বাদীর উপর।
৩.বিবাদীর যদি কোন প্রকার সাফাই বা প্রমাণ না থাকে তবেতাকে শপথ করতে হবে।
৪.উভয় পক্ষ সর্বাবস্থায় আপোষ-নিষ্পত্তি করতে পারবে। কবে আইণের বিরোধী ব্যাপারে আপোষ হকে পারবে না।
৫.মুকাদ্দমা ফায়সালা করার পর বিচারক ইচ্ছে করলে তা পুন বিবেচনা করতে পারবেন।
৬. মুকাদ্দমা শুনানীর জন্যে নির্দিষ্ট তারিখ হওয়া প্রয়োজন।
৭. নির্দিষ্ট তারিখে যদি বিবাদী হাজির না হয়, তবে এক তরফা ডিক্রি হবে।
৮. প্রত্যেক মুসলিমের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য, তবে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর সাক্ষ্য গৃহীত হবেনা।
বিচারক সম্পর্কে আলী (রাযিঃ) যেই সব অতিরিক্ত নীতি নির্ধারণ করেন সেগুলো হচ্ছেঃ
১. সমস্যার জটিলতা কিংবা সংখ্যার আধিক্যের কারণে তাদের কখনোই মিজাজের ভারসাম্য হারানো উচিত নয়।
২. যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবে যে প্রদত্ত রায় ভুল হয়েছে তা সংশোধন করা কিংবা সেই রায় বদলে দেয়া তাদের পক্ষে মোটেও মর্যাদাহানিকর ভাবা উচিত নয়।
৩. তারা লোভী, দুর্নীতি পরায়ণ ও চরিত্রহীন হতে পারবে না।
৪. যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা অভিযোগের এদিকও সেদিক আগাগোড়া যাচাই করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিশ্চিত হওয়া অনুচিত,যখন অস্পষ্টতা ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তখন আরো বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে নিয়ে তার পর রায় দিতে হবে।
৫. তাদের অবশ্যই যুক্তি প্রমাণের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং তাদেন কখনোই মামলাকারীর দীর্ঘ কৈফিয়াত শুনানোর ব্যাপারে অধৈর্য হলে চরবে না। বিশদ বিবরণের সূক্ষ নিরীক্ষণে এবং বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিথ্যা থেকে সত্যে উপনীত হবার কাজে অবশ্যই ধীরস্হির এবং অধ্যবসায়ী হতে হবে। আর এভাবে যখন সত্য আবিষ্কৃত হবে তখন তাদের নির্ভয়ে রায় প্রকাশ করে বিবাদের ইতি টানতে হবে।
৬. যাদের প্রশংসা করা হলে আত্মদর্পী হয়ে ওঠে, যারা তোষামোদে গলে যায়, এবং চাটুকারিতা ও প্ররোচনায় বিপথগামী হয় তাদের মধ্যে কেউ বিচারক হওয়া উচিত নয়।
ইসলাম আইনের শাসনে বিশ্বাসী। আর আইনের চোখে সবাই সমান। আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) শাসনকালে ফাতিসা নাম্মী এক উচ্চবংশীয় মহিলা চুরির অপরাধে গ্রেফতার হয়। উচ্চবংশীয়া হওয়ার কারণে কেউ কেউ তার লঘু শাস্তির কথা বলছিলো। রাসূল (সাঃ) ঘোষণা করলেন, "আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও যদি এই অপরাধ করতো, তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দেয়া হতোনা।"
একদিন আমীরুল মুমিনীন উমর (রাযিঃ) এবং উবাই ইবনে কাবের (রাযিঃ) মধ্যে কোন এক বিষয়ে বিবাদ ঘটে। উবাই মদীনার বিচারক যায়িদ ইবনে সাবিতের নিকট মুকাদ্দামা দায়ের করেন। সমন পেয়ে উমর (রাযিঃ) আদালতে হাজির হন। একজন সাধারণ আসামীর মতোই আচরণ করা হয় তাঁর সঙ্গে।
রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে খৃষ্টান আরবদের বসতি ছিলো। এই অঞ্চলের যুবরাজ জাবালা সেনাপতি আবু আরবদের বসতি ছিলো। এই অঞ্চলের যুবরাজ জাবালা সেনাপতি আবু উবায়দার নিকট ইসলাম গ্রহন করে মদীনায় আসেন। উমর (রাযিঃ) তাঁকে নিয়ে হজ্জ্ব করতে মক্কায় যান। ভীড়ের চাপে ক্রীতদাস জাবালার দামী পোশাকের কিয়দংশ পদদলিত করে। জাবালা গালে চড় বসিয়ে দেয়। যথাক্রমে ক্রীতদাস উমরের (রাযিঃ) নিকট নালিশ করে। উমর (রাযিঃ) জাবালাকে ডেকে সব কথা শুনে রায় দেন "হয় ক্রীতদাসকে আপনার গালে অনুরুপ একটি চড় মারতে দিন, নয়তো তাকে ক্ষতিপূরণ দিন।"
মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসের (রাযিঃ) পুত্র কপ্ট সম্প্রদায়ের এক ছেলের গালে চড় লাগায়। বিচার চাওয়া হয় উমরের (রাযিঃ) নিকট। তিনি নির্দেশ দিরেন কপ্ট ছেলেটি গভর্ণরের ছেলের গালে অনুরুপ চড় লাগাবে। কেউ কেউ আপত্তি তোলে। উমার (রাযিঃ) বলেন " কতকাল তোমরা মানুষকে গোলাম করে রাখতে চাও? তাতের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন মানুষরুপে জন্ম দিয়েছে।"
আলীর (রাযিঃ) শাসনকালে তাঁর একটি হারিয়ে যাওয়া বর্ম এক ইয়াহুদীর কাছে পাওয়া যায়। আলী (রাযিঃ) বিচারকের দ্বারস্হ হন। পুত্র ও গোলাম ছাড়া অন্য কোন সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিচারক মামলা খারিজ করে দেন।
খুলাফায়ে রাশিদীন নিজেদেরকে আইনের উর্ধে মনে করতেন না। বিচারক নিযুক্ত করার দায়িত্ব পালন করতেন রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু বিচারকগণ ইনসাফের দাবী অনুযায়ী রাষ্ট্র-প্রধানের বিরুদ্ধে নিঃসংকোচ রায় প্রদানের স্বাধীনতা ভোগ করতেন।
রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময়ে সাতন্ত্র পুলিশ বাহিনী ছিলো না। তবে অপরাধীকে ধরে আনার দায়িত্ব পালন করতেন কায়েস ইবনে সাদ (রাযিঃ)। আর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাযিঃ), আলী ইবনে আবী তালিব (রাযিঃ), মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাযিঃ), মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা (রাযিঃ), আসিম ইবনে সাবিত (রাযিঃ) এবং যাহহাক ইবনে সুফিয়ান কিলাবী (রাযিঃ)।
আবু বকরের (রাযিঃ) শাসনকালেও স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠেনি। উমরের (রাযিঃ) শাসনকালে পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠে। আলীর (রাযিঃ) শাসনকালে পুলিশ বাহিনীর নাম হয় শুরতাহ এবং এই বিভাগের প্রধান কর্মকর্তাকে বলা হতো সাহিবুশশুরতাহ।
বাজার পরিদর্শন, ওজন ও মাপ নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধ দমন এই বিভাগের কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
তথ্যসূত্র-
সীরাতুন নবী।
আল ফারুক।
হযরত আলী।
শাসক ওমর ফারুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন