ক্যাপশন যোগ করুন |
শবে বরাত উপলক্ষে পরের দিন ১৫ তারিখ অনেকেই রোজা রাখেন। এমনিতে কেউ চাইলে মাসের ১৫ তারিখ রোজা রাখতে পারে। কেননা পনেরো তারিখ হলো ‘আইয়্যামে বীয’ এর অন্তর্ভূক্ত। সে হিসেবে যদি কেউ ১৫ তারিখ রোজা রাখে, তাহলে সমস্যা নেই। আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি রাহি. বলেন-
وأما صيام يوم النصف منه فغير منهي عنه، فإنه من جملة أيام البيض الغر المندوب إلى صيامها من كل شهر. وقد ورد الأمر بصيامه من شعبان بخصوصه،
অর্থাৎ, শাবান মাসের ১৫ তারিখ রোজা রাখতে নিষেধ নেই। কারণ, ১৫ তারিখ হলো ‘আইয়্যামে বীজ’ এর অন্তর্ভূক্ত। আর প্রত্যেক মাসের এ তারিখে রোজা রাখা মুস্তাহাব। এছাড়া রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ করে শাবান মাসে রোজা রাখতে বলেছেন। (লাতায়িফুল মাআরিফ পৃষ্ঠা নং, ১৮৯ দারুল হাদিস , কাহেরা।)
কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ ১৫ তারিখ রোজা রাখেন শবে বরাতের রোজা মনে করে। এ সংক্রান্ত ‘ইবনে মাজাহ’ এর একটি রেওয়ায়াত দলিলস্বরূপ পেশ করা হয়। আলি রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها . فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا . فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر
অর্থাৎ, শাবান ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তোমরা নামাজ পড়ো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা আল্লাহ তাআলা সে রাতের সূর্যাস্তের সময় দুনিয়ার আসমনে অবতরণ করেন এবং বলেন, আছো কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তোমাকে ক্ষমা করবো। আছো কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী? আমি তোমাকে রিজিক প্রদান করবো। আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করব। এভাবে সুবহে সাদিক উঁদিত হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা ডাকতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৩৮৮, শায়খ ফুয়াদ আবদুল বাকী তাহকিককৃত।)
শবে বরাতের সময় বেশিরভাগ মসজিদের মিম্বরে হাদিসটি উচ্চারিত হয়। আলি রা. এর সূত্রে বর্ণিত এ হাদিসের উপর ভিত্তি করে অনেকেই শবে বরাত উপলক্ষে রোজা রাখেন। এজন্য হাদিসটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তুলে ধরছি।
প্রথম কথা হলো, হাদিসটি সহিহ নয়। জয়িফ তথা দুর্বল। হাদিসের একজন বর্ণনাকারী হলো ইবনে আবি সাবরা। তার নাম হলো, আবু বকর ইবনে আবদুল্লাহ বিন আবু সাবরা আল মাদানি। ইমাম জাহাবি রহ. তার ব্যাপারে বলেনÑ
أبو بكر بن عبد الله بن أبي سبرة ضعفه البخاري وغيره وروى عبد الله وصالح ابنا أحمد عن أبيهما قال: كان يضع الحديث، وقال النسائي: متروك وقال ابن معين ليس حديثه بشيء" اه.
অর্থাৎ, ইমাম বুখারি রহ. এবং অন্যান্যরা তাকে যয়িফ তথা দুর্বল বলেছেন।
আবদুল্লাহ বিন আহমদ এবং সালেহ বিন আহমদ তাদের পিতা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সে হাদিস জাল করতো।
ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহ. বলেন, তার বর্ণিত হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। ( মিযানুল এতেদাল : ৪/৪১৪)
এরপর ইমাম জাহাবি রহ. তার থেকে বর্ণিত মুনকার বর্ণনা সমূহের মাঝে এ হাদিস উল্লেখ করেছেন।
ইমাম ইবনে হিব্বান তার ব্যাপারে বলেন,
"كان ممن يروي الموضوعات عن الأثبات لا يحل كتابة حديثه ولا الاحتجاج به بحال، كان أحمد بن حنبل يكذبه" اه.
অর্থাৎ, সে গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে জাল হাদিস বর্ণনা করতো। তার সূত্রে বর্ণিত হাদিস লেখা জায়েজ নেই। কোনো অবস্থাতেই তার বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলীল দেওয়া যাবে না। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল তাকে মিথ্যুক বলেছেন।
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানি রহ. তার সম্পর্কে বলেন,
أبو بكر بن عبد الله بن محمد بن أبي سبرة بفتح المهملة وسكون الموحدة بن أبي رهم بن عبد العزى القرشي العامري المدني قيل اسمه عبد الله وقيل محمد وقد ينسب إلى جده رموه بالوضع وقال مصعب الزبيري: كان عالما من السابعة مات سنة اثنتين وستين ق.
অর্থাৎ তাকে হাদিস জাল করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। মুসআব বলেছেন, তিনি আলেম ছিলেন। (তাকরিবুত তাহজিব, তরজমা নং ৭৩১২)
আলী ইবনুল মাদিনি রহ. বলেন-
كان ضعيفا في الحديث
অর্থাৎ হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে সে যয়ীফ তথা দুর্বল।
তিনি অন্যত্র বলেন-
كان منكر الحديث هو عندي مثل بن أبي يحيى
অর্থাৎ সে আপত্তিকর বর্ণনাকারী। আমার নিকট সে ইবনে আবি ইয়াহইয়া এর মতো।
ইমাম নাসাঈ বলেন-
متروك الحديث
অর্থাৎ সে হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।
ইমাম ইবনে আদি রহ. বলেন-
عامة ما يرويه غير محفوظ وهو في جملة من يضع الحديث
অর্থাৎ তার অধিকাংশ বর্ণনা মাহফুয নয়। সে হাদিস জালকারীদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।
ইমাম সাজী বলেন-
عنده منا كير
সে আপত্তিকর বর্ণনাকারী।
হাকেম আবু আবদুল্লাহ বলেন-
يروي الموضوعات عن الاثبات مثل هشام بن عروة وغيره
সে গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারী থেকে জাল হাদিস বর্ণনা করে। হিশাম ইবনে উরওয়া এবং অন্যদের মতো। (তাহজিবুত তাহজিব, ১২/৩২ দারুল ফিকর, বায়রুত, প্রথম সংস্করণ।)
ইমাম ইবনে সাদ রহ. বলেন-
كان كثير الرحلة والسماع والرواية ولي قضاء مكة لزياد الحارثي وكان يفتي بالمدينة
হাদিস শুনা এবং বর্ণনা করার জন্য তিনি অনেক সফর করেছেন। তিনি মদীনায় ফতোয়া দিতেন।
ইমাম যাহাবি রহ. বলেন-
الفَقِيْهُ الكَبِيْرُ، قَاضِي العِرَاقِ، أَبُو بَكْرٍ بنُ عَبْدِ اللهِ بنِ مُحَمَّدِ بنِ أَبِي سَبْرَةَ بنِ أَبِي رُهْمٍ – وَهُوَ ضَعِيْفُ الحَدِيْثِ مِنْ قِبَلِ حِفْظِه.
অর্থাৎ তিনি উঁচু মাপের ফকীহ ছিলেন। ইরাকের বিচারক ছিলেন। স্মৃতি শক্তির কারণে তিনি হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে দুর্বল। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১৩/৩৭৪, শায়খ শুয়াইব আরনাউত তাহকিককৃত)
মোটকথা হলো- অধিকাংশ ইমামের মতে ইবনে আবি সাবরা হলেন মারাত্মক দুর্বল বর্ণনাকারী। কেউ কেউ থাকে হাদিস জালকারীও বলেছেন। এজন্য তার বর্ণিত এ হাদিস হলো চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্বল। আল্লামা ইবনুল জাওযী রহ. ‘আল ইলালুল মুতানাহিয়াহ’ এর মধ্যে বর্ণনাটি উল্লেখ করে বলেন-
هذا حديث لا يصح
অর্থাৎ বর্ণনাটি সহিহ নয়। (আল ইলালুল মুতানাহিয়াহ : ৩/৫৬১)
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আলী রা. এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসের প্রথম অংশের ভাবার্থ আরও অনেক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অর্থাৎ, শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতের ফজিলত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু রোজার বিষয়টি শুধুমাত্র আলি রা. এর বর্ণনায় রয়েছে। আর এ হাদিসটি মুনকার।
১৫ তারিখ যেহেতু ‘আইয়্যামে বীজ’ এর অন্তর্ভূক্ত, এজন্য কেউ চাইলে সে হিসেবে সেদিন রোজা রাখতে পারে। যেমনটা বলেছেন আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রহ.। কিন্তু শবে বরাত উপলক্ষে বিশেষ রোজা প্রমাণিত নয়৷
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন