শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

জন্মদিন নিয়ে এলোমেলো কিছু কথা।




এক।

আমি যখন আমার পেছনে তাকাই, তখন দিন, মাস, বছর পেরিয়ে চলে যাই সেই অতীতে, যেখানে আমার শুরু। আমার মুখের ভাঙ্গা, ভাঙ্গা কথা আর একটু হাসিতে তৃপ্ত হত সবাই। আমাকে নিয়ে কতই না স্বপ্নের জন্ম হয়েছিল তখন!

দুই।

আজ শৈশব, কৈশর আর অনেকটা সময় পেছনে ফেলে যৌবনে আমি। জীবন চলার বাঁকে জন্মদিয়েছি কত রূপকথা, ছোট বড় গল্প আর নাটক। ছোট্ট একটা জীবনে কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছি।! এই পৃথিবীতে এমনি একটি দিনে আমি এসেছিলাম, আজ সেই দিন। সেই জন্য আমি আমার সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আল আমিনের কাছে দায়বদ্ধ। তিনি আমায় সৃষ্টি করেছেন তিনিই আমার রব।

তিন।

জন্মানোর তারিখটা মনে হয় সবার কাছেই অনেক প্রিয় হয়। এবং দিনটাকে একান্তই নিজের মনে হয়! আসলে ডাইরির পাতা শেষ তো!

চার।

জন্মদিন মানে জীবন থেকে একটি বছর ঝড়ে যাওয়া। পৃথিবীর থেকে একটি বছর কমে যাওয়া। মৃত্যুর আরো কাছে চলে যাওয়া

পাঁচ।

জগতের লক্ষ কোটি মানুষের এই পথচলায় আমার অতি ক্ষুদ্র আমিটির পৃথিবীতে আগমন বা প্রস্থানে কোন ভাবেই আলাদা কোন গুরুত্ব বহন করে না!

ছয়।

জন্ম দিন পৃথিবীর সবার কাছে শ্রেষ্ঠ একটা দিন। জন্মদিন এমন একটা দিন যে দিনটাকে শুধু নিজের মনে হয়। যদিও এই দিনে পৃথিবীর প্রায় এক কোটি মানুষের জন্মদিন।

সাত।

জন্মদিনে আমরা সাধারণত যার জন্মদিন তাকেই শুধু শুভেচ্ছা জানাই, কিন্তু আমার মতে যাদের কারনে এবং ত্যাগের মাধ্যমে এমন সুন্দর পৃথিবীতে এসেছি তাদের অর্থাৎ বাবা মাকেও শুভেচ্ছা জানানো উচিত।

আট।

পৃথিবীর অদ্ভুত নিয়ম। এখানে এসেই কাঁদতে হবে। না কাঁদলে অন্যরা কাঁদবে। আমি কেঁদে সবার মুখের হাঁসি এনেছিলাম। বাকি জীবনও নিজে কেঁদে সবাইকে হাঁসি-খুুশি দিয়ে যাবো।

নয়।

এখন আর জন্মদিন আনন্দের মনে হয় না। উইশ আসতে থাকে একের পর এক। আর আমি ভাবি জীবন থেকে আরও একটি বছর হারিয়ে গেলো। বুড়ো হবার সকল উপসর্গ দেখা দিতে থাকে একের পর এক। আর প্রতিবছর আমার জন্মদিন আমাকে মনে করিয়ে দেয়, কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে। কবে শেষ আমি তার কিছুই জানি না।

দশ।

জন্ম ব্যাপারটাকে যত খুশির বলে মনে করা হয়, আসলে তা তেমন খুশির নয়। জন্ম হওয়া মানে মৃত্যু ফলে বিজ বোনা। আর মৃত্যুর কথা স্মরণ হলেই মন খারপ হয়ে যায়। এই বুঝি আজরাইল হাজির হইল। খালি ভয়। অবশ্য আল্লাহ ও তার রাসূল (সা) মৃত্যুকে স্মরণ করতে বলেছেন বেশী বেশী। এতে মন নরম হয়। জগতের প্রতি মোহ থাকে না।

এগারো।

আজ থেকে মৃত্যুর এক বছর কাছাকাছি চলে এলাম! জীবনটা অনেক সুন্দর যদি সুন্দর করে দেখা যায়। তবে একথাও ঠিক, বিচিত্র এই জীবনে, বৈচিত্রময় হয়ে ওঠা অনেকটাই কঠিন। যারা হয়ে উঠতে পারে তাদেরকেই মানবজাতি সারাজীবন মনে রাখে। আমার কথা তো কাল সকলেই ভুলে যাবে! তাতে আমার কোন আফসোস নেই, নেই কোন অভিযোগ। আমি সুধু ক্ষমাপ্রার্থী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে।


    বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০

    সুবিচার ও আইনের শাসন

     
    আশরাফ আলী সুমন
     
    আল কুরআনে আল্লাহ বলেন,
    "আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় বিচার ও ইহসানের নির্দেশ দিচ্ছেন"।
    নবীজী (সাঃ)র উপস্হিতিতে বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ আসনে নবী ছাড়া আর কারো আসীন হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা। তাই মদীনা রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ও ছিলেন মুহাম্মাদ (সাঃ)।

    রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময়ে মাঝে মধ্যে বিচার ফয়সালার দায়িত্ব পালন করেছেন আবু বকর (রাযিঃ), উমর (রাযিঃ), উসমান (রাযিঃ), আলী (রাযিঃ), আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাযিঃ), উবাই ইবনে কাব (রাযিঃ), এবং মুয়ায ইবনে জাবাল (রাযিঃ)।

    আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বাযান ইবনে সামানকে ইয়েমেনে, মুহাজির ইবনে উমাইয়াকে কিন্দা ও ফাদাক এলাকায়, যিয়াদ ইবনে লবীদুল আনসারীকে হাজরামাউতে, আবু মুসা আলআশোয়ারীকে যুবায়দ, যামআ ও আদন অঞ্চলে, মুয়ায ইবনে জাবালকে জুন্দে, আমর ইবনে হামযাকে নাজরানে, ইয়াজিদ ইবনে সুফিয়ানকে তাইমায়, ইত্তাব ইবনে উসাইদকে মক্কায়, আমর ইবনুল আসকে আম্মানে এবং আলা ইবনে হাদরামীকে বাহরাইনে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। আইন শৃঙ্খলা সংরক্ষণের সাথে সাথে তারাঁ বিচার ফায়সালাও করতেন।

    আবু বকরের (রাযিঃ) শাসনকালে তিনি নিজেই ছিলেন প্রধান বিচারপতি এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নিযুক্ত গভর্ণরগণ বিচার ফায়সালায়দর দায়িত্বও পালন করতেন। তারঁ শাসনকালে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্হা উপড়িয়ে ফেলার ডেই ভয়াবহ ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়েছিলো তার মুকাবেলায় তাঁকে অনেক সময় খরচ করতে হয়। তদুপরি তাঁর শাসনকালই ছিলো মাত্র দু'বছর তিন মাস। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য বিকল্প কোন ব্যবস্হা গড়ে তোলার সুযোগ তিনি পাননি। কিন্তু উন্নত মানের ব্যক্তিদের হাতে প্রশাসন ও বিচারের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকার সুবিচার বিন্দুমাত্রও বিঘ্নিত হয়নি।

    উমর (রাযিঃ) তাঁর শাসনকালের উক্ত ব্যবস্হাই বহাল রাখেন।শিগগির তিনি উপলব্ধি করেন যে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করে ফেলাই উত্তম।
    তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে  বিচারক নিযুক্ত করে তাঁদের জন্যে যেই ফরমান পাঠান তার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপঃ
    ১. বিচারক সব মানুষের সাথে সমান ব্যবহার করবেন।
    ২.সাক্ষ্য প্রমাণের দায়িত্ব সাধারণতঃ বাদীর উপর।
    ৩.বিবাদীর যদি কোন প্রকার সাফাই বা প্রমাণ না থাকে তবেতাকে শপথ করতে হবে।
    ৪.উভয় পক্ষ সর্বাবস্থায় আপোষ-নিষ্পত্তি করতে পারবে। কবে আইণের বিরোধী ব্যাপারে আপোষ হকে পারবে না।
    ৫.মুকাদ্দমা ফায়সালা করার পর বিচারক ইচ্ছে করলে তা পুন বিবেচনা করতে পারবেন।
    ৬. মুকাদ্দমা শুনানীর জন্যে নির্দিষ্ট তারিখ হওয়া প্রয়োজন। 
    ৭. নির্দিষ্ট তারিখে যদি বিবাদী হাজির না হয়, তবে এক তরফা ডিক্রি হবে।
    ৮. প্রত্যেক মুসলিমের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য, তবে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারীর সাক্ষ্য গৃহীত হবেনা।
    বিচারক সম্পর্কে আলী (রাযিঃ) যেই সব অতিরিক্ত নীতি নির্ধারণ করেন সেগুলো হচ্ছেঃ
    ১. সমস্যার জটিলতা কিংবা সংখ্যার আধিক্যের কারণে তাদের কখনোই মিজাজের ভারসাম্য হারানো উচিত নয়।
    ২. যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবে যে প্রদত্ত রায় ভুল হয়েছে তা সংশোধন করা কিংবা সেই রায় বদলে দেয়া তাদের পক্ষে মোটেও মর্যাদাহানিকর ভাবা উচিত নয়।
    ৩. তারা লোভী, দুর্নীতি পরায়ণ ও চরিত্রহীন হতে পারবে না।
    ৪. যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা অভিযোগের এদিকও সেদিক আগাগোড়া যাচাই করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিশ্চিত হওয়া অনুচিত,যখন অস্পষ্টতা ও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তখন আরো বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে নিয়ে তার পর রায় দিতে হবে।
    ৫. তাদের অবশ্যই যুক্তি প্রমাণের উপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং তাদেন কখনোই মামলাকারীর দীর্ঘ কৈফিয়াত শুনানোর ব্যাপারে অধৈর্য হলে চরবে না। বিশদ বিবরণের সূক্ষ নিরীক্ষণে এবং বিষয়বস্তু বিশ্লেষণের মাধ্যমে মিথ্যা থেকে সত্যে উপনীত হবার কাজে অবশ্যই ধীরস্হির এবং অধ্যবসায়ী হতে হবে। আর এভাবে যখন সত্য আবিষ্কৃত হবে তখন তাদের নির্ভয়ে রায় প্রকাশ করে বিবাদের ইতি টানতে হবে।
    ৬. যাদের প্রশংসা করা হলে আত্মদর্পী হয়ে ওঠে, যারা তোষামোদে গলে যায়, এবং চাটুকারিতা ও প্ররোচনায় বিপথগামী হয় তাদের মধ্যে কেউ বিচারক হওয়া উচিত নয়।

    ইসলাম আইনের শাসনে বিশ্বাসী।  আর আইনের চোখে সবাই সমান। আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) শাসনকালে ফাতিসা নাম্মী এক উচ্চবংশীয় মহিলা চুরির অপরাধে গ্রেফতার হয়। উচ্চবংশীয়া হওয়ার কারণে কেউ কেউ তার লঘু শাস্তির কথা বলছিলো। রাসূল (সাঃ) ঘোষণা করলেন, "আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমাও যদি এই অপরাধ করতো, তাকে শাস্তি থেকে রেহাই দেয়া হতোনা।"

    একদিন আমীরুল মুমিনীন উমর  (রাযিঃ) এবং উবাই ইবনে কাবের (রাযিঃ) মধ্যে কোন এক বিষয়ে বিবাদ  ঘটে। উবাই মদীনার বিচারক যায়িদ ইবনে সাবিতের নিকট মুকাদ্দামা দায়ের করেন। সমন পেয়ে উমর (রাযিঃ) আদালতে হাজির হন। একজন সাধারণ আসামীর মতোই আচরণ করা হয় তাঁর সঙ্গে।

    রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রদেশ সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে খৃষ্টান আরবদের বসতি ছিলো। এই অঞ্চলের যুবরাজ জাবালা সেনাপতি আবু আরবদের বসতি ছিলো। এই অঞ্চলের যুবরাজ জাবালা সেনাপতি আবু উবায়দার নিকট ইসলাম গ্রহন করে মদীনায় আসেন। উমর (রাযিঃ) তাঁকে নিয়ে হজ্জ্ব করতে মক্কায় যান। ভীড়ের চাপে ক্রীতদাস জাবালার দামী পোশাকের কিয়দংশ পদদলিত করে। জাবালা গালে চড় বসিয়ে দেয়। যথাক্রমে ক্রীতদাস উমরের (রাযিঃ) নিকট নালিশ করে। উমর (রাযিঃ) জাবালাকে ডেকে সব কথা শুনে রায় দেন "হয় ক্রীতদাসকে আপনার গালে অনুরুপ একটি চড় মারতে দিন, নয়তো তাকে ক্ষতিপূরণ দিন।"

    মিসরের গভর্ণর আমর ইবনুল আসের (রাযিঃ) পুত্র কপ্ট সম্প্রদায়ের এক ছেলের গালে চড় লাগায়। বিচার চাওয়া হয় উমরের (রাযিঃ) নিকট। তিনি নির্দেশ দিরেন কপ্ট ছেলেটি গভর্ণরের ছেলের গালে অনুরুপ চড় লাগাবে। কেউ কেউ আপত্তি তোলে। উমার (রাযিঃ) বলেন " কতকাল তোমরা মানুষকে গোলাম করে রাখতে চাও? তাতের মায়েরা তো তাদেরকে স্বাধীন মানুষরুপে জন্ম দিয়েছে।"

    আলীর (রাযিঃ) শাসনকালে তাঁর একটি হারিয়ে যাওয়া বর্ম এক ইয়াহুদীর কাছে পাওয়া যায়। আলী (রাযিঃ) বিচারকের দ্বারস্হ হন। পুত্র ও গোলাম ছাড়া অন্য কোন সাক্ষী হাজির করতে না পারায় বিচারক মামলা খারিজ করে দেন।

    খুলাফায়ে রাশিদীন নিজেদেরকে আইনের উর্ধে মনে করতেন না। বিচারক নিযুক্ত করার দায়িত্ব পালন করতেন রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু বিচারকগণ ইনসাফের দাবী অনুযায়ী রাষ্ট্র-প্রধানের বিরুদ্ধে নিঃসংকোচ রায় প্রদানের স্বাধীনতা ভোগ করতেন।
    রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সময়ে সাতন্ত্র পুলিশ বাহিনী ছিলো না। তবে অপরাধীকে ধরে আনার দায়িত্ব পালন করতেন কায়েস ইবনে সাদ (রাযিঃ)। আর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেন যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রাযিঃ), আলী ইবনে আবী তালিব (রাযিঃ), মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ (রাযিঃ), মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা (রাযিঃ), আসিম ইবনে সাবিত (রাযিঃ) এবং যাহহাক ইবনে সুফিয়ান কিলাবী  (রাযিঃ)।

    আবু বকরের (রাযিঃ) শাসনকালেও স্বতন্ত্র পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠেনি। উমরের (রাযিঃ) শাসনকালে পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠে। আলীর (রাযিঃ) শাসনকালে পুলিশ বাহিনীর নাম হয় শুরতাহ এবং এই বিভাগের প্রধান কর্মকর্তাকে বলা হতো সাহিবুশশুরতাহ।
    বাজার পরিদর্শন, ওজন ও মাপ নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধ দমন এই বিভাগের কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিলো।

    তথ্যসূত্র-
    সীরাতুন নবী।
    আল ফারুক।
    হযরত আলী।
    শাসক ওমর ফারুক।

    পান -কাহিনি


    পান-কাহিনি
    -------------------

    মূল: আতীক উল্লাহ

    সংযোজন-সংশোধন: আশরাফ আলী সুমন

    এক.
    পান খাওয়া একটা আর্ট। উপমহাদেশের গরিবের বিলাসী আয়েশ। বনেদি বড়লোকদের কারও কারও মধ্যেও পানবিলাস আছে। আমাদের জাতীয় কবিকে একবাটা পান দিয়ে বসিয়ে দিলে আর দেখতে হতো না! পানের রসের সাথে সাথে থাকত গানের পর গান। 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস' এভাবে তার কাছ থেকে বহু গান বাগিয়ে নিয়েছে।

    ★★★

    পান খাওয়া কাকে বেশি মানায়? নারী না পুরুষকে? আমরা একবার বিষয়টা নিয়ে ঘরোয়া বিতর্কের আয়োজন করেছিলাম। বেশ মজার এক বির্তক হয়েছিল। অদ্ভুত সুন্দর সুন্দর সব যুক্তি উঠে এসেছিল পক্ষে-বিপক্ষে। শেষ দিকে অবশ্য পানের চেয়ে লাল ঠোঁট নিয়েই বির্তক বেশি জমে উঠেছিল।

    দুই.
    এশার পর পুরো কামরা সুনসান। সবই পড়ছে। কেউ কেউ গুনগুন করে বন্ধুর সাথে কথা বলছে। সবাই নিচু গ্রামেই আওয়াজ করছে। পরদিন সুল্লামুল উলূম কিতাবের কঠিন পড়ায় মগ্ন। জাঁদরেল ডাকসাইটে বাঘ 'আইয়ুব সাহেব হুযুর' এর পড়া শিখছি। সামনের পড়াটাও ঠিক করে রাখছি। পড়া না পারলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন। তটস্থ অবস্হা। রাতের মধ্যেই পড়াটা 'পেড়ে' ফেলতে হবে। পাশাপাশি কানটাও খোলা। কিছু একটার জন্য তৃষ্ণার্ত-চাতক-প্রতীক্ষা। উৎকর্ণ। দশটার কিছু আগেই সাধারণত ঘটনাটা ঘটে।

    ★★★

    সময়ের খুব বেশি হেরফের ঘটে না। আজও ঘটল না। ঘড়ির কাঁটা তখন ন'টা পঁয়তাল্লিশের ঘর পেরিয়েছে। দরজা খুলে গেল, সাথে সাথে গুঞ্জরিত হলো,

    পান খায়ে সাঁইয়া হামারো
    সম্ভালি সূরতিয়া হোঁট লাল লাল
    হায় হায় মলমল কা কুর্তা
    মলমল কে কুর্তে পে ছিট লাল লাল!

    আমাদের কামরার মুহাম্মদ রফি ছিল খুরশিদ (ছদ্মনাম অবশ্যই)। মায়ানমারের রসিক পানসেবী। জীবনে বহু পানখোর দেখেছি, লেকিন ওইসা কভি নেহি!। মানুষ তো পান খায়। আমাদের মনে হতো খুরশিদ পান নয়, যেন মান্না-সালওয়া খাচ্ছে। সবাই পিচিক করে পানের পিক ফেলে দেয়, সে ফেলতো না। কার সোজাসাপ্টা বক্তব্য:
    -পিক ফেলব তো পান খাওয়া কেন? পিক না গিললে কি নেশা জমে? পানের পিক হলো  শরাবান তাহুরা। বলবাড়িষ্ঠাসিক সালসা!

    সে পান তো খেতই, সাথে সাথে পানবিষয়ক অসংখ্য গান-কবিতা, শের-আশআরও মুখস্হ করেছিল। আড্ডায় বসলে সে তার 'পানবাহার' খুলে বসত। তার বেশি প্রিয় ছিল 'পান খায়ী'টা। প্রতিদিনই দিনের শেষে খিলি মুখে দিয়ে পানের জারক রসে আপ্লুত হয়ে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে রুমে ফিরত। প্রতিটি লাইনকে সে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে গাইত। ছুটির দিনে মন ভালো থাকলে সে নাচসহই পরিবেশন করত। ঠিক যেন 'জীবন্ত পুরুষ ওয়াহিদা রেহমান'। তার কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ভেঙে পড়তাম। খুরশিদ নির্বিকার। নেচে গেয়ে 'পান-উপাসনা'করছে!
    তৃতীয় লাইনটাকে একটু এদিক-সেদিক তরে গাইত,
    হায় হায় টেট্রন কা কুর্তা
    টেট্রন কে কুর্তে পে ছিট লাল লাল
    খুরশিদ সস্তা টেট্রন-পলিস্তারের 'কুর্তা' গায়ে দিত। বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে কুর্তার ওপর কিছুটা পিকের লাল ছিটাও ছিটিয়ে দিত। গাওয়ার সময় পুরো মুদ্রার ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিত কীভাবে পান বানাতে হয়। নাচটা শিখেছিল সে 'আরেকজন'কে দেখে দেখে!

    রাত দশটায় হোস্টেলের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। আর বেরুবার উপায় ছিল না। আগে জানতাম মদের নেশা চাপে। হিরোইনের নেশা চাপে। কিন্তু পানেরও যে দুর্দম দুর্নিবার নেশা চাপে সেটা জানা ছিল না। সেই প্রথম দেখলাম।

    ★★★

    এক গভীর রাতে খুরশিদের পানের 'টক' উঠল। এখন উপায়? চুপি চুপি পাশের জনকে ডেকে তুলল। সেও খুরশিদের পান-স্যাঙাত। তার কাছে তালিম নিচ্ছে পান-উপাসনার। তার এখন 'জর্দাচেনা' পর্ব চলছে। কোন জর্দার কী নাম। কেমন স্বাদ।
    তাদের দুজনের অনুচ্চ ফিসফিসও নিঝুম রাতে সুউচ্চ হয়ে কানের সোনার সিস্টেম ধরা পড়ল। চোখ খুলতেই দেখলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দুজন কথা বলছে। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। আলগোছে ছিটকিনি খুলে বাইরে গেল। গোয়েন্দা মন টিকটিক করে উঠল। চোখ ঠেরে বলল:
    -ওনে! তাড়াতড়ি পিছু নে, না হলে কিছু একটা মিস করে ফেলবি।
    তড়াক করে উঠেই চুপিচপি পিছু নিলাম। ওরা দুজন চলতে চলতে মাদরাসারপূর্ব কোণের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল। দূর থেকে তাদের ভাবগতি বুঝতে পারছিলাম না। একটা নারকেল গাছ আছে দেয়ালের কাছটিতে। খুরশিদ প্রথমে ওটার চড়তে শুরু করল। আচ্ছা! নারকেল চুরি হচ্ছে! না, এবার স্যাঙাতও চড়তে শুরু করল। গাছ থেকে টপকে দেয়ালের ওপাশে নামল। মাদরাসার বাইরে। কিছুক্ষণ বোবার মতো দাঁড়িয়েথেকে ফিরে এলাম। দেয়াল টপকানোর সাহস হলো না। ফজরে উঠে দেখলাম দুই পানসাধক তখনো লাপাত্তা। ব্যাপার কী? রাতে ফিরতে পারেনি? নাকি দেয়াল টপকাতে গিয়ে বেঘোরে হাত-পা ভেঙেছ!

    নামায পড়ে বের হলাম। শাহী গেইটের কাছে বড়সড় জটলা। কাছে গেলাম। শুনলাম রাতে দুজন চোর  ধরা পড়েছে। মাদরাসার কয়েদখানায় আটকে রাখা হয়েছে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, ওরা নয় তো! কাছে গিয়ে দেখি, অনুমান সত্যি! খুরশিদ কয়েদখানায় বসে তখনো নির্বিকারচিত্তে পান চিবুচ্ছে। আর পান-স্যাঙাত বেজার মুখে বসে আছে।

    আমরা কামরার সবাই গিয়ে অনেক বলে-কয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম। কামরায় এসেই চেপে ধরলাম,
    -পানগুরু! ঝেড়ে কাশো দেখি চাঁদু!
    -আর বলিন না! রাথে ভীষণ পানের টক উঠল। প্রতিরাতে বাড়তি কয়েক খিলিব প্যাকেট করে নিয়ে আসি। কাল আনা হয়নি। বাইরে গেলাম পান খেতে। দুঃসাহসীক অভিযান। রেলস্টেশনে গেলাম। দোকান বন্ধ। ডাকবাংলা গেলাম, সব বন্ধ। থানার দুয়ারে গেলাম। মদীনা হোটেলের সামনের দোকানটাও তখন প্রায় বন্ধ হবে হবে করছে। দৌগে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ওখানে দাঁড়িয়েই ডাবলখিলি সাঁটালাম। দশ খিলি বাড়তি পকেটে পুরে রওনা দিলাম।

    সব ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। আমি গাছ বেয়ে উপরে উঠে গেছি, শিষ্য তখনো ওপারে। টেনে তুললাম। লাফ দিয়ে নামলাম। ওটাই ভুল হয়ে গেছে। দুপ করে আওয়াজ হলো। ভাগ্য খারাপ। দারোয়ান তোতা মিঞা তখন ওই এলাকায় টহল দিচ্ছিল। আওয়াজ শুনে তিন ব্যাটারি লাইট মারল। আর যায় কোথায়! আমি দৌড়ে পালাতে পারতাম। কিন্তু শিষ্যটা আলোর ঝলকানিতে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। কী আর করা, ওর জন্যে আমিও আটকা পড়লাম।
    আহাঁ! হামনে মাঙায়ী সুরমেদানী
    লে আয়ি জালিম বেনারস কা জর্দা!
    একরাত কারাবাস করে আমাদের 'পানগাজী' আরও পান-রসিক হয়ে উঠল। প্রতি রাতেই তার সুর ঝংকৃত হতো,
    =পান খায়ে সাঁইয়া হামারো....

    ★★★

    এ তো গেল একদিনের ঘটনা। পান নিয়ে এমন হাজারো পানাহার আছে। পান-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খুরশিদের কিছু গবেষণা আছে।
    (ক) কোন পান বেশি মিষ্টি, গোড়ার, মধ্যের নাকি আগার? কোন এলাকার পান, মহেশখালী নাকি অন্য কোন জায়গার পান বেশি মিষ্টি?
    (খ) সুপুরির প্রকার নিয়েও আছে। পানিতে মদানো-গ্যাঁজানো সুপুরির স্বাদ বেশি নাকি শুকনোটার? শুকনোটারমধ্যেও সেদ্ধ করা সুপুরি নাকি সাধারণটা?
    (গ) পানের পিক ফেলা হবে কি না, ফেললে ক'বার?
    (ঘ) দিনে কয় খিলি মারতে হবে? কতক্ষণ পর পর?
    (ঙ) কীভাবে পান খেলে ঠোঁট বেশি লাল হবে?
    (চ) পান খাইয়ে কীভাবে 'ইয়ে'-কে বশ করা যায়! এটা ছিল খুরশিদ'স এক্সক্লুসিভ ওয়ান!

    পানবিষয়ক আরও কিছু 'অফ দ্য রেকর্ড' বিষয় খুরশিদের ট্যাঁকে ছিল। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে বের হতো সেগুলো। দুর্লভ মুক্তোর মতো। মাদরাসা ছুটির আগের রাতের আড্ডায়, পরীক্ষার শেষদিন বিকেলেই সাধারণত তার কাছ থেকে আমরা এসব দক্ষিণা পেতাম।

    এমনিতেই মাদরাসাজীবনে আমাদের আনন্দের উপকরণের কোনো অভাব ছিল না। তার ওপর খুরশিদের মতো যদি জীবন্ত 'পান খায়ে সাঁইয়া'-ধর্মী আনন্দ-বোমা সাথে থাকে, আর কিছু লাগে!

    ★★★

    খুরশিদের রেওয়ায়েত করা একটা পান-ঘটনা বলে শেষ করি।
    -(ওয়া বিহি ক্বালা হাদ্দাসানা খুরশিদ): আমাদের এক পাড়াতো ভাইয়ের বিয়ে। দাওয়াত পেলাম। পান পরিবেশনের দায়িত্বটাও যথারীতি আমার কাঁধেই বর্তায়। সব কাজ শেষ। দুলাকে বাসর ঘরে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা ভীষণ উত্তেজিত। এখনকার বোকাসোকা বরগুলো তো বাসরে যাওয়ার আগে 'রেড বুল' খায়। ভাবে তারাও 'বুল' হয়ে উঠবে! যত্তসব রাবিশ! আরে, ভালো করে একখিলি পান খেয়ে যা! আর কিছুই লাগবে না। এতেই 'বুল' বাবা ফুল হয়ে উঠবে। বদ্দাকে বললাম: 
    -খুইল্যা (সেজো ভাই)! একদম নিশ্চিত থাকুন। এক খিলি বিশেষ ফর্মুলায় পান বানিয়ে দিচ্ছি! দেখবেন কোন ফাঁকে রাত কেটে গেছে টেরও পাবেন না।
    -ঠিক আছে দে!
    আমর্ পান খাইয়ে বদ্দাকে ঠেলে ঠেসে 'সোহাগরাত'-রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে এলাম। বদ্দা লাল ঠোঁটে, চকচকে চোখে চলে গেলেন। আমরা হঠাৎ একা হয়ে গেলাম। পাঁচ মিনিটও যায়নি, ভেতর বাড়ি থেকে হইচই শোনা গেল। কী হলো! কী হলো! দৌড়ে গেলাম। দুলা নাকি বেহুশ হয়ে গেছে। প্রথমে মাথা চক্কর দিয়েছিল, বড় বড় ঢেকুর উঠতে শুরু করেছিল। একপর্যায়ে বমি করে নেতিয়ে পড়েছে। দেখলাম, বেহুশ হয়নি।অর্ধচেতন অবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল। আসলে পানটা উত্তেজনার মধ্যে হজম করতে পারেনি। নতুন বউ অল্প সময়েই স্বামীর প্রেমে কুঁইকুঁই করে কাঁদছে। বর উঠল:
    -দুলাকে পান কে খাইয়েছে?
    -খুরশিদ্যে!
    খুইশ্যা হডে, ইতেরে দরি আন!
    দেখলাম, অবস্হা বেগতিক। এক দৌড়ে পালিয়ে এলাম। একমাস আর বাড়িমুখো হইনি। পান-চিকিৎসা বন্ধ!

    ★★★

    একটা পানীয় বাণী পড়ে বিদায় নিই:
    -পান আর নারীতে কোনো পার্থক্য নেই। পান কোমল, নারীও কোমল। পান বরজের মধ্যে মাচানের আড়ালে থাকে, নারীও পর্দার মধ্যে থাকে। এর ব্যতিক্রম হলে পান সূর্যের আলোয় নষ্ট হয়ে যায়, পর্দাহীন নারীও পুরুষের কুদৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে পড়ে বা পুরুষকে নষ্ট হতে সহায়তা করে। এছাৃড়াও পান আর নারীর মধ্যে বড় একটা মিল আছে....(সেন্সরড)।
    (আও কামা কালা...)। -বিশিষ্ট পান-দার্শনিক খুরশিদ।

    কেন তিনি জাতীয় কবি। বিদ্রোহী কবি। সাম্যের কবি।

    কেন তিনি বিদ্রোহী 'কবি? কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার কবিতা যুগে যুগে কোটি তরুণকে দ...